একটি দেশের জাতীয় আয়ের ধারণা থেকে সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝা যায়। অর্থাৎ দেশটি কী উন্নত, উন্নয়নশীল, না অনুন্নত এ সম্পর্কে ধারণা করা যায় । কোনো দেশের জাতীয় আয় কত, তা জানার জন্য জাতীয় আয় পরিমাপ করতে হয়। এ অধ্যায়ে বাংলাদেশে জাতীয় আয় গণনার পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
মোট দেশজ উৎপাদন ( Gross Domestic Product বা GDP)
একটি নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণত এক বছরে একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে মোট যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবা উৎপাদিত হয়, তার বাজার দামের সমষ্টিকে মোট দেশজ উৎপাদন বা GDP বলে।
মনে করি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বছরে তিনটি দ্রব্য উৎপাদিত হয়। যেমন- ১০০ কুইন্টাল ধান, ১০০০ জামা এবং ১০০০ কলম উৎপাদিত হয় । জিডিপি = ১০০ কুইন্টাল ধান × ধানের বাজার দাম + ১০০০ জামা × জামার বাজার দাম + ১০০০ কলম × কলমের বাজার দাম। এভাবে কোনো দেশে উৎপাদিত সকল দ্রব্যের পরিমাণকে নিজ নিজ দাম দ্বারা গুণ করে তার সমষ্টি বের করে জিডিপি নির্ণয় করা হয় । তবে ধান থেকে যদি চূড়ান্ত দ্রব্য হিসাবে চাল তৈরি হয়, তাহলে আমাদেরকে হিসাবের সময় ধানের বদলে চাল উৎপাদন এবং চালের দামকে হিসাবে নিতে হবে।
মোট জাতীয় আয় ( Gross National Income বা GNI)
কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণত আর্থিক বছরে কোনো দেশের নাগরিকগণ কর্তৃক যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্ৰব্য ও সেবা উৎপন্ন হয় তার বাজার মূল্যের সমষ্টিকে মোট জাতীয় আয় (GNI) বলে ।
মোট দেশজ উৎপাদনের সাথে নিট উপাদান আয় যোগ করে মোট জাতীয় আয় পাওয়া যায় । নিট উপাদান আয় বলতে একটি দেশের নাগরিকগণ বৈদেশিক বিনিয়োগ ও শ্রম থেকে যে আয় করে এবং বিদেশি নাগরিকগণ আলোচ্য দেশে বিনিয়োগ ও শ্রম থেকে যে আয় করে এ দুয়ের বিয়োগ ফলকে বোঝায় । এই পরিমাণটি ঋণাত্মক হলে মোট জাতীয় আয় মোট দেশজ আয়ের চেয়ে কম হবে। আর এটি যদি ধনাত্মক হয়,তাহলে মোট জাতীয় আয় মোট দেশজ আয়ের চেয়ে বেশি হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে দ্বিতীয়টিই সত্য।
নিট জাতীয় আয় (Net National Income বা GNI)
কোনো জাতির মোট জাতীয় আয় থেকে মূলধন ব্যবহারজনিত অবচয় পুরণের ব্যয় ( Capital Consumption Allowance বা Depreciation) বাদ দিলে যা থাকে তাকে নিট জাতীয় আয় বলে । মূলধন ব্যবহারজনিত অবচয় ব্যয় বলতে উৎপাদন-ব্যবস্থায় মূলধনের ব্যবহারজনিত যে ক্ষয় হয়, তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে ব্যয় বহন করতে হয়, তাকে বোঝায় ৷
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) মূলত তিনভাবে পরিমাপ করা যায়। যথা: উৎপাদন পদ্ধতি (Production Approach), আয় পদ্ধতি (Income Approach) ও ব্যয় পদ্ধতি (Expenditure Approach)।
১. উৎপাদন পদ্ধতি (Production Approach): একটি দেশের অর্থনীতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিভক্ত । এসব খাতে এক বছরে উৎপাদিত চূড়ান্ত দ্রব্য ও সেবার মূল্য যোগ করে মোট দেশজ উৎপাদ নির্ধারণ করা হয় । বাংলাদেশে অর্থনীতিকে ১৫টি খাতে বিভক্ত করা হয় এবং খাতওয়ারি উৎপাদনের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। পরিশেষে ১৫টি খাতের উৎপাদনের মূল্য যোগ করে মোট দেশজ উৎপাদন নির্ধারণ করা হয় ।
২. আয় পদ্ধতি (Income Approach) : এ পদ্ধতিতে মোট দেশজ উৎপাদন হলো উৎপাদন কার্যে ব্যবহৃত উপকরণসমূহের প্রাপ্ত আয়ের সমষ্টি । উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মৌলিক উপকরণ ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠন। এদের প্রাপ্ত আয় যথাক্রমে খাজনা, মজুরি, সুদ ও মুনাফা। অতএব মোট দেশজ উৎপাদন খাজনা + মজুরি + সুদ + মুনাফা ।
৩. ব্যয় পদ্ধতি (Expenditure Approach) : এ পদ্ধতিতে জিডিপি হলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের সব ধরনের ব্যয়ের যোগফল । সমাজের মোট ব্যয় বলতে ব্যক্তি খাতের ভোগ ও বিনিয়োগ ব্যয় এবং সরকারি ব্যয় ও নিট রপ্তানিকে বোঝায় । অতএব, ভোগ + বিনিয়োগ + সরকারি ব্যয় + নিট রপ্তানি (= রপ্তানি – আমদানি) = মোট দেশজ উৎপাদন। মোট দেশজ উৎপাদন বা Y= C + I + G + (X-M) এখানে C = ভোগ, I = বিনিয়োগ, G = সরকারি ব্যয়, (X-M) (রপ্তানি - আমদানি) = নিট রপ্তানি ।
উপরিউক্ত তিনটি পদ্ধতিতে পরিমাপকৃত মোট দেশজ উৎপাদন মোটামুটি কাছাকাছি হলে পরিমাপ সঠিক হয়েছে বলে ধরা হয়। গণনা বা হিসাবের ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে খানিকটা পার্থক্য হতে পারে, তবে প্রকৃত অর্থে তা একই ফলাফল বহন করে ।
মাথাপিছু জিডিপি বলতে জনপ্রতি বার্ষিক জিডিপিকে বোঝায় । কোনো নির্দিষ্ট আর্থিক বছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনকে উক্ত বছরের মধ্য সময়ের মোট জনসংখ্যা দ্বারা ভাগ করলেই মাথাপিছু জিডিপি পাওয়া যায় ।
সূত্রাকারে, মাথাপিছু জিডিপি-
ঐ বছরের মধ্য সময়ের মোট জনসংখ্যা মাথাপিছু জিডিপি হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মানের গড় প্রধান সূচক । বিশ্বব্যাংকের ধ্যানধারণা অনুসারে এ সূচক দ্বারা দেশটি কি উন্নত নাকি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল তা নির্ণয় করা যায় । যদি মাথাপিছু জিডিপি একটি নির্দিষ্ট স্তরের বেশি হয় তবে বুঝতে হবে দেশটি উন্নত, আর যদি তা থেকে কম হয় তবে বুঝতে হবে দেশটি অনুন্নত বা উন্নয়নশীল । তবে বর্তমানে এ ভাবে না দেখে উচ্চ আয়ের দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ এবং নিম্ন আয়ের দেশ হিসাবে দেখার রীতি চালু হয়েছে।
মোট দেশজ উৎপাদন কত হবে তা নির্ভর করে দেশের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রম, মূলধন, প্রযুক্তি, এসব সম্পদের পরিমাণ ও উৎপাদনশীলতার উপর। এ জন্য এদেরকে মোট দেশজ উৎপাদনের নির্ধারক বলা হয় ।
১. ভূমি (Land) : মোট দেশজ উৎপাদন ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে । প্রাকৃতিক সম্পদের পর্যাপ্ত ব্যবহার সম্ভব হলে এবং কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উর্বর ভূমি থাকলে দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ফলে ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ মোট দেশজ উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক।
২. শ্রম (Labour) : যেকোনো দেশের শ্রম মোট দেশজ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। দক্ষ ও কর্মক্ষম শ্রম মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক। শ্রমিকের সংখ্যা যদি বাড়ে এবং সে যদি প্রযুক্তির ব্যবহার জানে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়, তবে মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক হয় ।
৩. মূলধন (Capital) : মূলধন মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নির্ধারক । আজকের উন্নত দেশসমূহে মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির মূলে মূলধন কাজ করে । আবার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ মূলধনের অভাবের কারণে মোট জাতীয় আয় ও মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে না । সুতরাং মূলধন মোট দেশজ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক ।
৪. প্রযুক্তি (Technology) : প্রযুক্তির উপর মোট দেশজ উৎপাদন বহুলাংশে নির্ভর করে । প্রযুক্তির উন্নয়ন নানাভাবে হতে পারে । যেমন নতুন আবিষ্কার, যন্ত্রপাতির ডিজাইন ও দক্ষতার উন্নতি, নতুন মালামালের আবিষ্কার ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি খাতে চিরায়ত বীজের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বীজ ব্যবহার করে ধানের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে । একইভাবে উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার করে লাউ, কুমড়া, ঢেঁড়স ইত্যাদি সবজির উৎপাদনও বেড়েছে। প্রযুক্তি মূলত উৎপাদন উপকরণের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে একই সমান উৎপাদন উপকরণ দিয়ে অধিক উৎপাদন সম্ভব হয়।
৫. সচলতা (Mobility) : একটি অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া বা অবনতিশীল অর্থনৈতিক কার্যকলাপ থেকে সম্পদ সরিয়ে নতুন প্রসারমাণ অর্থনৈতিক কার্যকলাপে সম্পদ ব্যবহার করার ক্ষমতার উপর মোট দেশজ উৎপাদন নির্ভর করে । উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে পাট চাষ কমিয়ে ধান, গম বা ভুট্টা চাষে ভূমি ও অন্যান্য উপকরণের ব্যবহার বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা যায়।
কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একটি অর্থনীতিতে চূড়ান্ত পর্যায়ের উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার বাজারমূল্যের সমষ্টিকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বলে। জিডিপি গণনার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত উপাদানসমূহ কখনও অন্তর্ভুক্ত করা হয় না ।
১. মূলধনী লাভ-ক্ষতি (Capital Gains & Losses) : সময়ের পরিবর্তনে জাতীয় সম্পদের বা উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের উপকরণ বা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পরিবর্তনের ফলে লাভ বা ক্ষতি হতে পারে । এ লাভ বা ক্ষতি জিডিপি গণনার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না । কারণ, সময়ের ব্যবধানে সম্পদের মূল্য পরিবর্তনজনিত লাভ বা ক্ষতি জিডিপি গণনার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে না। তাছাড়া এ লাভ-ক্ষতি শুধু কাগজ-কলমে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে লিপিবদ্ধ করা হয় । যে প্রতিষ্ঠানের লাভ যতটুকু হয়,অন্য প্রতিষ্ঠানের এর সমপরিমাণ ক্ষতি হয় । ফলে জিডিপি গণনায় লাভ-ক্ষতির প্রভাব শূন্য ।
২. মাধ্যমিক দ্রব্য ও সেবা (Intermediary Goods and Services) : জাতীয় আয় গণনায় শুধু চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্য ও সেবা বিবেচিত হয়। কারণ চূড়ান্ত পর্যায়ের দ্রব্যের ভেতরেই মাধ্যমিক পর্যায়ের দ্রব্য ও সেবার মূল্য অন্তর্ভুক্ত হয়। চূড়ান্ত দ্রব্যের পরে আবার মাধ্যমিক পর্যায়ের দ্রব্য ও সেবা বিবেচনা করলে জাতীয় আয় গণনার ক্ষেত্রে দ্বৈত গণনা (Double Counting) সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের দ্রব্য ও সেবাকে জিডিপি গণনার সময় বিবেচনা করা হয় না ।
৩. বিনামূল্যে ব্যবহৃত দ্রব্য ও সেবা (Goods and Services Free of Charge): অর্থনীতিতে এমন কিছু দ্রব্য ও সেবা রয়েছে যেগুলো বাজারের মাধ্যমে বেচা-কেনা হয় না। যেমন- মা কর্তৃক সন্তান লালন-পালন, মহিলাদের রান্না বান্না ইত্যাদি সাংসারিক কাজকর্ম, গায়ক কর্তৃক বন্ধুদের গান শোনানো ইত্যাদি কোনো পণ্য নয়। এ জন্য জিডিপি গণনায় এসব অপণ্যায়িত সেবার মূল্য অন্তর্ভুক্ত করা যায় না ।
৪. অতীতে উৎপাদিত পণ্য ও লেনদেন বিবেচ্য নয় (No Consideration of Previous Production and Transaction) : যে বছরের জিডিপি গণনা করা হয়, তার পূর্বের কোনো বছরের উৎপাদন ঐ আলোচ্য বছরের মোট দেশজ উৎপাদনে অন্তর্ভুক্ত হয় না। যেমন— পুরাতন গাড়ি, পুরাতন বাড়ি বা ফ্ল্যাট ক্রয়। এসব দ্রব্য যে বছর উৎপাদিত হয়েছে ঐ বছরের জিডিপির মধ্যে এসবের মূল্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি পুনরায় হিসাব করলে এক বছরের আয় আরেক বছরের আয়ের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। অনুরূপভাবে স্টক, বন্ড, কাগজি লেনদেন জিডিপির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না ।
৫. সরকারি ঋণের সুদ (Interest on Public Debt) : সরকারি ঋণের বিপরীতে যে সুদ দেওয়া হয় তা জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত নয় । যেমন- যুদ্ধকালীন সরকার যে ঋণ করে তা জাতীয় উৎপাদনে কোনো ভূমিকা রাখে না। এ ঋণের বিপরীতে সুদ হস্তান্তর পাওনা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ জন্য জিডিপি থেকে বাদ দেওয়া হয় ।
৬. বেআইনি কাজ (Illegal activities) : বেআইনি কাজ থেকে প্রাপ্ত আয় জাতীয় আয় গণনার ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না। বেআইনি কার্যকলাপ বলতে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং দেশের প্রচলিত আইনের বিরোধী কাজকে বোঝায় ।
বাংলাদেশে জিডিপি গণনার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রতি বছর চলতি বাজার মূল্য ও স্থির মূল্যে দ্রব্য ও সেবার মূল্য পরিমাপ করে জিডিপি গণনা করে থাকে । এসব হিসাব করতে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো উৎপাদন পদ্ধতি ও ব্যয় পদ্ধতি ব্যবহার করে জিডিপি ও জিএনআই গণনা করে । উৎপাদন পদ্ধতিতে মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) পরিমাপের জন্য অর্থনীতিকে মোট ১৫টি প্রধান খাতে বিভক্ত করা হয় । খাতসমূহ হচ্ছে—
১. কৃষি ও বনজ সম্পদ : কৃষি দেশজ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাত ধরাবাঁধাভাবে হিসাব করা কঠিন । বাংলাদেশে GDP গণনা করতে এ খাতকে তিনটি উপখাতে বিভক্ত করা হয় ।
শস্য ও শাকসবজি : এখাতে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ চলতি পাইকারি বাজারমূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে হিসাব করা হয় । যেমন- ২০১৪-১৫ সালে ছিল ১,২৬,১২১ কোটি টাকা এবং ২০১৫-১৬ সালে ১৩৪৩২২ কোটি টাকা ।
(খ) প্রাণিসম্পদ : এ খাতের হিসাবও চলতি বাজার মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয় । প্রাণি সম্পদ উপখাতে ২০১৪-১৫ সালে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৯,৮৮৫ কোটি টাকা এবং ২০১৫-১৬ সালে ৩৩, ১৬৫ কোটি টাকা ।
(গ) বনজ সম্পদ : বন খাতের উপকরণের তথ্যের অভাবে মোট উৎপাদন হতে ৩% মূল্য বাদ দিয়ে যা থাকে, তাকে মূল্য সংযুক্তি হিসেবে বিবেচনা করে GDP বের করা হয় । ২০১২-১৩ সালে দেশজ উৎপাদন ছিল ১৬,৬০৫ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ২০,৪৯৪ কোটি টাকা । ২০১৫-১৬ সালে ২২,৮২৭ কোটি টাকা ।
২.মৎস্য সম্পদ : অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক উৎস থেকে মোট মৎস্য আহরণের প্রেক্ষিতে মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাব করা হয়। এখাতে ২০১২-১৩ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৬,৯৯৫ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ৪৭,৫৮১ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে ৫৩,০৭৬ কোটি টাকা ৷
৩.খনিজ ও খনন : শিল্প খাতের মধ্যে খনিজ ও খননকে আলাদা খাত হিসাবে চিহ্নিত করা হয় । এ খাতে (ক) প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল এবং (খ) অন্যান্য খনিজ সম্পদ ও খনন বিষয়ের উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্যের হিসাব করা হয় । এসব খাতের হিসাব দেশজ উৎপাদনের দিক থেকে গণনা করা হয় । ২০১২-১৩ সালে এ খাতে আয় হয় ১৯,৪৬১ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে হিসাব করা হয়েছিল ২৩,৮৭৬ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে ২৮,৫৭৮ কোটি টাকা ।
8. শিল্প (ম্যানুফেকচারিং): বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন গণনার ক্ষেত্রে সকল শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করে মোট দেশজ উৎপাদন বের করা হয় । বাংলাদেশে শিল্প উৎপাদনের পরিমাণ ২০১৪-১৫ সালে শিল্প উৎপাদন বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র শিল্প উৎপাদন যথাক্রমে ২,৫৪,৪৮৩ কোটি টাকা; ২,০৫,৯৯২ কোটি টাকা এবং ৪৮,৪৯১ কোটি টাকা । ২০১৫-১৬ সালে শিল্প উৎপাদন বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র শিল্প উৎপাদন যথাক্রমে ২৯৫১১১ কোটি টাকা, ২৪০১৬৪ কোটি টাকা, ৫৪৯৪৭ কোটি টাকা ।
৫. পাইকারি ও খুচরা বিপণন : এ হিসাবে পণ্যের পাইকারি মূল্য হিসাবের মাধ্যমে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ গণনা করা হয়। ২০১২-১৩ সালে ১,৫৪,৫৭৯ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ১,৯২,৫৮৫ কোটি টাকা হিসাব করা হয় । ২০১৫-১৬ সালে ২,২৪,২৫৭ কোটি টাকা।
৬. বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানিসম্পদ : এ খাতে সেবা সরবরাহ মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে মোট দেশজ উৎপাদন মূল্য হিসাব করা হয় । বাংলাদেশের জন্য এই খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সরকারের পাশাপাশি এ খাতসমূহ বেসরকারিভাবেও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ২০১২-১৩ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৬৩৮১ কোটি টাকা । এর মধ্যে (ক) বিদ্যুৎ উপখাতে ১২১৬৮ কোটি টাকা । (খ) গ্যাস উপখাতে ৩৪৪৮ কোটি টাকা এবং (গ) পানি উপখাতে ৭৬৬ কোটি টাকা আয় হয় । ২০১৪-১৫ সালে এ তিনটি খাতের সমষ্টি ১৯,৮৬৮ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে ২৩,৮২৯ কোটি টাকা ৷
৭. নির্মাণ : নির্মাণ খাত থেকে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয় ব্যক্তি, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, ভোক্তা এবং সরকারের প্রাপ্ত তথ্য থেকে । বাস্তবে এ খাত থেকে যে পরিমাণ আয় হিসাব হওয়ার কথা তার তুলনায় কম হয় । কারণ চলতি বাজারমূল্য সরকার প্রদত্ত বেঁধে দেয়া মূল্য থেকে বেশি ।অথচ সরকারি বেঁধে দেয়া মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয় । ২০১২-১৩ সালে এ খাত থেকে আয় হয় ৮২৪৩২ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ১০৮৪৮৪ কোটি টাকা । ২০১৫-১৬ সালে ১,২৬,৩৫৩ কোটি টাকা ।
৭.হোটেল ও রেস্তোরাঁ : এই খাতের মোট দেশজ উৎপাদনের বিষয়টি উৎপন্ন দ্রব্যের ও সেবার বিক্রয় মূল্যের প্রেক্ষিতে হিসাব করা হয়। ২০১২-১৩ সালে এ খাত থেকে আয় হয় ১১২৬৩ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সময়ে ১৪,৯২৮ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে ১৭,০৫৮ কোটি টাকা ৷
৯. পরিবহণ, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ : এ খাত দেশজ আয় গণনার একটি বড় খাত। এ খাতটির বড় অংশ বেসরকারি হাতে ন্যাস্ত আছে। তারপরও ২০১২-১৩ সালে স্থুল আয় হয়েছিল মোট ১,২৪,২৮১ কোটি টাকা যার মধ্যে- (ক) স্থল পথ পরিবহন উপখাতে ৯২১৮৩ কোটি টাকা, (খ) পানি পথ পরিবহন উপখাতে ৭৬৪৯ কোটি টাকা, (গ) আকাশ পথ পরিবহন উপখাতে ১০৪৭ কোটি টাকা, (ঘ) সহযোগী পরিবহন সেবা ও সংরক্ষণ উপখাতে ৬০০১ কোটি টাকা এবং (ঙ) ডাক ও তার যোগাযোগ খাতে ১৭৪০০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ সময়ে পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ খাতে মোট আয় হয় ১,৫০,০২৫ কোটি টাকা । ২০১৫-১৬ সালে ১,৬৯,১৬৫কোটি টাকা ।
১০. আর্থিক প্রাতিষ্ঠানিক সেবা : এ খাতের হিসাব করা হয় সেবা থেকে প্রাপ্ত মূল্যের ভিত্তিতে । ২০১২-১৩ সময়ে এ খাত থেকে দেশজ উৎপাদন মূল্যের পরিমাণ ছিল ৪২২৩৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে- (ক) ব্যাংক উপখাতে ৩৪৭২৭ কোটি টাকা; (খ) বিমা উপখাতে ৪৯২০ কোটি টাকা এবং (গ) অন্যান্য খাত থেকে আয় হয় ২৫৯০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট ৫৫,৭৬১ কোটি টাকা আয় হয় । উপখাত অনুযায়ী এ আয় যথাক্রমে ৪৬৬৪৪, ৫৯৩৮ ও ৩১৮০ কোটি টাকা । ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৩,৬০১ কোটি টাকা এবং উপখাতে যথাক্রমে ৫৩৭৮৯, ৬৩২৭ ও ৩৪৮৫ কোটি টাকা ।
১১. রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবসা : এ খাত থেকে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয় সেবা থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাপের ভিত্তিতে। ২০১২-১৩ সালে এ খাত হতে প্রাপ্ত দেশজ আয় ছিল ৭৮৮২০ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সময়ে ১০,০৬০ কোটি টাকা । ২০১৫-১৬ সালে ১২৩৭৪০ কোটি টাকা।
১২. লোকপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা : এ খাত থেকে প্রাপ্ত দেশজ আয়ের হিসাব করা হয় মূলত ব্যয়ের দিক থেকে । ২০১২-১৩ সালে দেশজ উৎপাদণ ছিল ৩৭৬৭৮ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ৫০,৬৭৪ কোটি টাকা । যা ২০১৫-১৬ সালে ৬৬৭১১ কোটি টাকা ।
১৩. শিক্ষা : বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদন হিসাব করা হয় ব্যয়ের দিক থেকে। ২০১২-১৩ সালে এ খাতে দেশজ উৎপাদন ছিল ২৮৪২৯ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ৩৭, ৬২৪ কোটি টাকা । ২০১৫-১৬ সালে ৪৬৫১২ কোটি।
১৪. স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা : স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের বিষয়টি হিসাব করা হয় ব্যয় পদ্ধতিতে। এক্ষেত্রে মোট দেশজ উৎপাদন ব্যয় ২০১২-১৩ সময়ে হয়েছিল ২৩৮৬৮ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সময়ে ব্যয় ৩০,১৩৫ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে ৩৪৭৫৮ কোটি টাকা।
১৫. কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা : এ খাতে ব্যয়ের দিক থেকে মোট দেশজ উৎপাদণ গণনা করা হয় । ২০১২-১৩ সালে এ খাত থেকে ১৩৮৯৫২ কোটি টাকা ব্যয় গণনা করা হয় এবং ২০১৪-১৫ বছরে ১,৭৬,৪০২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল । ২০১৫-১৬ সালে ১,৯৪,২৪৮কোটি টাকা।
[ এই অধ্যায়ের প্রদত্ত যাবতীয় তথ্যের উৎস: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০১৭]
আরও দেখুন...